হাসিনার ভাষণের পর উত্তাল বাংলাদেশ, পুড়ল বাসভবন সুধা সদন, চলল বুলডোজার
৫ ফেব্রুয়ারি : বাংলাদেশের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পর ধানমন্ডি ৫/এ–তে আওয়ামি লিগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদনে আগুন দেওয়া হয়েছে। বুধবার রাত সাড়ে ১০টার পর সেখানে আগুন দেওয়া হয় বলে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণকক্ষে দায়িত্বরত কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান সেদেশের ‘প্রথম আলো’ সংবাদ মাধ্যমকে জানান, রাত সাড়ে ১১টার দিকে সুধা সদনে আগুনের খবর পান তাঁরা। সেখানে আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।
ওই এলাকায় দায়িত্বরত ধানমন্ডি সোসাইটির নিরাপত্তারক্ষীরা জানান, রাত সাড়ে ১০টার পর ১০–১২টি ছেলে এসে সুধা সদনে আগুন দেয়। আগুন ভবনটিতে ছড়িয়ে পড়লে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লোকেরা এসে এসব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। পরে আশপাশের ভবনের বাসিন্দারা এসে পানি দিয়ে নিচতলার আগুন কিছুটা কমিয়েছেন।
রাত ১২টার সময় ভবনের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলার বিভিন্ন কক্ষে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে।
এ দিকে, ‘২৪-এর বিপ্লবী ছাত্র জনতা’ ধানমন্ডি ৩২ নম্বর ভাঙার ঘোষণা দিতেই তা ভেঙেছে। রাত আটটার দিকে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-জনতা ৩২ নম্বর বাড়ির গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে। এরপর তাদের ক্ষোভ বাড়ির দেয়ালের ওপর আছড়ে পড়ে। শাবল, রড, হাতুড়ি যার হাতে যা ছিল তা দিয়েই বাড়ির দেয়াল ভাঙতে থাকে। ‘নারায়ে তাকবীর, আল্লাহ আকবার’ স্লোগান দিতে দিতে জনতার স্রোত ৩২ নম্বরের বাড়িতে প্রবেশ করে।
এর আগে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে ভারতে অবস্থান নেওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার ভাষণ দেওয়াকে কেন্দ্র করে ফেসবুকে ধানমন্ডি-৩২ অভিমুখে ‘বুলডোজার মিছিলের’ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়। পাশাপাশি ‘মার্চ টু ধানমন্ডি-৩২’ কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়। এ কর্মসূচিকে ঘিরে সরকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে সেনা মোতায়েন করে। তবে ছাত্র-জনতার ক্ষোভের মুখে শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী সেখান থেকে সরে যায়।
রাতে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রসংগঠন ছাত্রলিগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে শেখ হাসিনার ভাষণ প্রচার করা হয়। একে কেন্দ্র করে গতকাল বিকেলে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে ফেসবুকে একাধিক পোস্ট দেন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য শরিফ ওসমান হাদি। রাত ৯টায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে যাওয়ার কথা থাকলেও পরে কর্মসূচি পরিবর্তন করে রাত ৮টায় নিয়ে আসা হয়। রাত আটটার আগেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ধানমন্ডিতে গিয়ে ৩২ নম্বরের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ শুরু হয়। এক পর্যায়ে ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর শুরু হয়। এর আগে সন্ধ্যা সাতটার পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘আজ রাতে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমিমুক্ত হবে।’
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছিল বিক্ষুব্ধ জনতা। এরপর থেকে বাড়িটি অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। ভেঙে ফেলার ঘোষণা দিয়ে ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির ভেতরে সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরেই প্রবেশ করেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী-জনতা।
জুলাই রেভুল্যুশনারি অ্যানসার মুখপাত্র ফানতাসির মাহমুদ বলেন, ‘আমরা সন্ধ্যার পর থেকে ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে আছি। প্রতি মিনিটে শত শত মানুষ আসছে। আমরা বুলডোজার দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম স্বৈরাচারের চিহ্ন মুছে দিতে চাই। রাতে ছাত্রসমাজের উদ্দেশে গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামি লিগ সভাপতি শেখ হাসিনা ভার্চ্যুয়ালি বক্তব্য দেবেন বলে ঘোষণা দেন। তার এ ঘোষণার পরই ছাত্র-জনতার মাঝে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।
এ নিয়ে রাতে বিশিষ্ট অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও ব্লগার পিনাকী ভট্টাচার্য ধানমন্ডি ৩২ নিয়ে তার ব্যক্তিগত ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজে একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন। রাত ৮টার দিকে ১ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের এ ভিডিও বার্তা দেন পিনাকী। ভিডিও বার্তায় পিনাকী বলেন, ‘প্রিয় দেশবাসী! আসসালামু আলাইকুম। আজ রাত ৯টায় গণহত্যাকারী, খুনি, নির্লজ্জ, ফ্যাসিস্ট হাসিনা ছাত্রদের উদ্দেশে বক্তব্য দেওয়ার খায়েশ করেছে। এ স্পর্ধার জবাব দিতে হবে। এ স্পর্ধার জবাব দেব আমরা ধানমন্ডি ৩২ নম্বর গুঁড়িয়ে দিয়ে। ভিডিও বার্তায় পিনাকী আরও বলেন, যে মুহূর্তে সে বক্তব্য দেওয়া শুরু করবে, সেই মুহূর্তে আপনারা দলে দলে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বুলডোজার নিয়ে আসবেন। বুলডোজার না পাওয়া গেলে হাতুড়ি শাবল গাঁইতি নিয়ে আসবেন। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর আজ থেকে আর থাকবে না। ইতিহাসের দায় মোচন করবেন ফ্যাসিবাদের আঁতুরঘর নিশ্চিহ্ন করতে আসবেন। স্লোগানের কথা উল্লেখ করে পিনাকী আরও বলেন, গান গাইতে গাইতে আসবেন, স্লোগান দিতে দিতে আসবেন, সন্তানের হাত ধরে আসবেন। মুখে হাসি আর বুকে প্রতিরোধের আগুন নিয়ে আসবেন। ফ্যাসিবাদের ধ্বংসস্তূপের উপরে ছাত্রজনতার বিজয় নিশান ওড়াতে আসবেন। আজ রাত ৯টায় সেই ইতিহাস রচিত হোক। আবু সাঈদ, মুগ্ধ আসবে আপনাদের দেখানো পথে। আসেন অসমাপ্ত কাজ আজ আমরা সম্পাদন করি। ইতিহাসের দায় মোচন করি ধানমন্ডি ৩২ নাম্বার থাকবে না। ছাত্র জনতার ঐক্য জিন্দাবাদ। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’
আওয়ামি লিগ সভাপতি শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচারকে ঘিরে ফের ভাঙচুরের মুখে পড়ে ধানমন্ডির ২৩ নম্বরের বাড়ি। রাতে শেখ হাসিনার বক্তব্য আওয়ামি লিগের ফেসবুক পেজে প্রচার করা হয়। পলাতক অবস্থায় তার এ বক্তব্য প্রচারকে ঘিরে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়াদের মাঝে। দিনেই ঘোষণা দেয়া হয় শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচারের সময় ধানমন্ডির ৩২ এর বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হবে। রাত আটটার দিকে দলে দলে শিক্ষার্থীরা ধানমন্ডি-৩২ এর দিকে যেতে থাকেন। রাত আটটার পরপরই ফটক ভেঙে শিক্ষার্থী ও জনতা ভবনের ভেতরে প্রবেশ করেন। রাত নয়টার দিকে ভবনের একটি অংশে আগুন জ্বলতে দেখা যায়।
৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের দিনেই শেখ মুজিবুর রহমানের বাসস্থান ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয় ছাত্র-জনতা। ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের কারণে এ ভবনটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল।
খবর : প্রথম আলো ও দৈনিক ইনক্লাব পত্রিকা ডিজিটাল।