ইসলামের ইতিহাসের একটি জীবন্ত অধ্যায় মহরম মাস
বরাক তরঙ্গ, ৬ জুলাই : পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই নানা ঘটনাপ্রবাহের ঐতিহ্য বহন করে আসছে পবিত্র মহরম মাস। বিশেষত কারবালার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মহরম মাস আরও বেশি স্মরণীয় হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায় ১০ই মহরম। মহরম কেবল একটি মাস নয়, বরং ইসলামের ইতিহাসের একটি জীবন্ত অধ্যায়, যেখানে বিষাদ, সংগ্রাম ও আধ্যাত্মিকতার মিশ্রণ রয়েছে।
১০ মহরম ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে শাহাদতের অমিয় সুধা পান করেন হজরত হোসাইন (রা.)। হিজরি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহরম তাৎপর্যমণ্ডিত একটি মাস। মুসলিম ইতিহাসে এ মাসটি বিভিন্ন কারণে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।
আসমান-জমিন সৃষ্টিসহ পৃথিবীতে অনেক স্মরণীয় ও যুগান্তকারী ঘটনা এ মাসের ১০ তারিখে অর্থাৎ পবিত্র আশুরার দিন সংঘটিত হয়েছিল। মহরম সংশ্লিষ্ট ২০টি ঘটনার সংক্ষিপ্ত ভাবে তুলে ধরা হলো-
১. আকাশ জমিন পাহাড়-পর্বত সব কিছু সৃষ্টি। ২. আদম (আ.)-এর সৃষ্টি । ৩. নূহ (আ.) মহাপ্লাবন শেষে জুদি পাহাড়ে অবতরণ। ৪. হজরত ইবরাহিম (আ.) নমরুদের প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ড থেকে মুক্তিলাভ। ৫. দীর্ঘ ১৮ বছর রোগ ভোগের পর হজরত আইয়ুব (আ.)-এর দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তিলাভ। ৬. হজরত সুলাইমান (আ.)কে পৃথিবীর রাজত্ব দান। ৭. হজরত ইউনুস (আ.)কে ৪০ দিন পর দজলা নদীতে মাছের পেট থেকে উদ্ধার। ৮. হজরত মূসা (আ.) ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা। ৯. হজরত ঈসা (আ.)-এর পৃথিবীতে আগমন এবং জীবতাবস্থায় আসমানে উত্তোলন। ১০. হজরত ইদ্রিস (আ.) কে আসমানে উত্তোলন। ১১. হজরত দাউদ (আ.)কে বিশেষ সম্মানে ভূষিত। ১২. খায়বার যুদ্ধের বিজয় অর্জন। ১৩. মাদায়েন এবং কাদিসিয়ার যুদ্ধে বিজয় অর্জন। ১৪. হজরত আদম (আ.)-এর জান্নাতে প্রবেশ। ১৫. হজরত আদম (আ.) কে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় প্রেরণ এবং গুনাহ মার্জনার পর তার সঙ্গে হাওয়া (আ.)-এর পুনঃসাক্ষাৎ লাভ। ১৬. হজরত নূহ (আ.) কে তুফান ও প্লাবন থেকে পরিত্রাণ প্রদান। ১৭. হজরত সোলায়মান (আ.) কে হারানো বাদশাহি ফিরিয়ে দেওয়া। ১৮. হজরত ইয়াকুব (আ.) কর্তৃক হারানো পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ। ১৯. প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা শরিফ থেকে হিজরত করে মদিনা শরিফে আগমন। ২০. হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তার ৭৭ ঘনিষ্ঠজন স্বৈরশাসক ইয়াজিদের সৈন্য কর্তৃক কারবালা প্রান্তরে নির্মমভাবে শাহাদতবরণ।
মহানবী (সা.)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য চান্দ্রমাসের হিজরি সাল গণনার সূচনা হয়।
শুধু ১০ মহরম নয়, এই মাসজুড়ে ঘটেছে ইতিহাসের অবিস্মরণীয় ও ব্যথাতুর নানা ঘটনা। এরমধ্যে কয়েকটি হল-
২ মহরম : কারবালায় হোসাইন (রা.)-এর প্রবেশ। ৬৮০ সালে, হিজরি ৬১ সনে হোসাইন ইবন আলি (রা.) কারবালায় প্রবেশ করেন এবং তাঁর শিবির স্থাপন করেন। ইয়াজিদের সেনাবাহিনী তাঁদের ঘিরে ফেলে।
কুফার দিকে যাওয়ার পথে উমাইয়া সৈন্যরা তাঁদের থামান এবং কারবালার মরুভূমিতে শিবির স্থাপন করতে বাধ্য করেন, যেখানে জল বা কোনও সুরক্ষা দেয়াল ছিল না। এই ঘটনা কারবালার ট্র্যাজেডির সূচনা করে (আল-তাবারি, তারিখ আল-তাবারি, ৫/৩৯১, দারুল কুতুব, ১৯৬৭)।
৭ মহরম: জল নিষিদ্ধকরণ। ৬৮০ সালে, হিজরি ৬১ সালে ইয়াজিদের নির্দেশে হোসাইন (রা.)-এর শিবিরের জন্য জল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে হোসাইন (রা.) ও তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে তীব্র তৃষ্ণা ও ক্ষুধার সৃষ্টি হয়। (আল-তাবারি, তারিখ আল-তাবারি, ৫/৪০১, দারুল কুতুব, ১৯৬৭)
৮ মহরম : জয়নুল আবেদীন (রা.)–এর মৃত্যু। ৯৫ হিজরির এই দিনে ইমাম জয়নুল আবেদীন (রা.) মৃত্যু। কোনও কোনও বর্ণনা মতে উমাইয়া খলিফ ওয়ালিদের নির্দেশে তাকে বিষপানে শহিদ করা হয়। তিনি ছিলেন হোসাইন ইবন আলি (রা.)-এর পুত্র এবং কারবালার ট্র্যাজেডির সাক্ষ্য হয়ে বেঁচে থাকা একমাত্র পুরুষ সদস্য।
৯ মহরম : আলোচনার ব্যর্থতা। ৬৮০ সালের এই দিনে হোসাইন (রা.) ও উমাইয়া বাহিনীর মধ্যে আলোচনা ভেঙে পড়ে। উমাইয়া নেতা উমার ইবন সাদ বিকেলে নামাজের পর আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু তাঁকে পরের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি করানো হয়। হোসাইন (রা.) ও তাঁর অনুসারীরা সেই রাত ইবাদতে কাটান। (আল-তাবারি, তারিখ আল-তাবারি, ৫/৪১১, দারুল কুতুব, ১৯৬৭)
১০ মহরম : আশুরা ও কারবালার যুদ্ধ৷ এ দিন আশুরার দিন। নবীজি (সা.) বলেন, ‘আশুরার দিনের রোজা পূর্ববর্তী এক বছরের পাপের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করা হবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৬২)
৬৮০ সালে এদিনেই কারবালার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। হোসাইন ইবন আলি (রা.), তাঁর ভাই আব্বাস (রা.) এবং তাঁর পরিবারের অধিকাংশ পুরুষ সদস্য উমাইয়া সৈন্যদের হাতে শাহাদাত বরণ করেন। যুদ্ধের শেষে উমাইয়া সৈন্যরা হোসাইন (রা.)-এর শিবিরের নারী ও শিশুদের বন্দী করে দামেস্কে নিয়ে যায়। (আল-তাবারি, তারিখ আল-তাবারি, ৫/৪২৩, দারুল কুতুব, ১৯৬৭)
১৬ মহরম : প্রথম কিবলা নির্ধারণ। নবীজি (সা.) বাইতুল মুকাদ্দাসকে প্রথম কিবলা হিসেবে নির্ধারণ করেন। পরবর্তীকালে কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে কিবলা কাবার দিকে পরিবর্তিত হয়, ‘আমরা তোমার মুখকে আকাশের দিকে বারবার ফিরতে দেখি, তাই আমরা তোমাকে এমন কিবলার দিকে ফিরিয়ে দেব, যা তুমি পছন্দ কর।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৪৪)
১৭ মহরম : হস্তির ঘটনা। ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে মক্কায় ‘হাতিওয়ালাদের’ আগমন ঘটে, যা কোরানের সুরা ফিলে উল্লেখিত হয়েছে, ‘তুমি কি দেখনি, তোমার রব হাতিওয়ালাদের সঙ্গে কী করেছেন?’
২০ মহরম : বেলাল (রা.)-এর ইন্তেকাল। ১৭ বা ১৮ হিজরির এই দিন ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন বেলাল (রা.) ইন্তেকাল করেন। তাঁর আজানের আহ্বান ইসলামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। (ইবন সাদ, আত-তাবাকাতুল কুবরা, ৩/২৩২, দার সাদির, ১৯৬০)
বিভিন্ন তথ্য থেকে সংগৃহীত।