শরীফনগরে চাঁদা তুলে সড়কের গর্ত ভরাট বাজার কমিটি ও গ্রামবাসীর

মোহাম্মদ জনি, পাথারকান্দি। 
বরাক তরঙ্গ, ৫ জুলাই : সরকার উন্নয়নের স্লোগানের মাঝে যখন শহর ও গ্রামাঞ্চলের রাস্তা-ঘাটে আলো জ্বলছে বলে দাবি করা হচ্ছে, ঠিক তখনই শ্রীভূমি জেলার অন্তর্গত শরীফনগর বাজার এলাকার মানুষ আজও হাঁটু-জলে ডুবে দুর্ভোগের জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন।

দক্ষিণ করিমগঞ্জ বিধানসভার অন্তর্গত কালিগঞ্জ জেলা পরিষদের আওতাধীন মেদল-শরীফনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের শরীফনগর বাজার এলাকার মধ্যে দিয়ে যাওয়া পূর্ত বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি দীর্ঘদিন যাবৎ ভয়াবহ অবহেলার শিকার হয়ে পড়ে রয়েছে। এই রাস্তার প্রায় এক কিলোমিটার অংশ দীর্ঘ দুই-তিন বছর ধরে বেহাল অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এর মধ্যে শরীফনগর বাজারের মধ্যবর্তী অংশে একটি বিশাল আকৃতির গর্ত পড়ে গিয়ে আজ তা কার্যত পুকুরে রূপান্তরিত হয়েছে।

বৃষ্টি হলেই গর্তে জমে হাঁটু সমান জল। রাস্তার অধিকাংশ জায়গা জুড়ে খানা-খন্দ ও কাদামাটি। এমন অবস্থায় শিশু থেকে বৃদ্ধ—সবাইকে প্রতিদিনই নাভিশ্বাস উঠিয়ে চলাফেরা করতে হয়। রাস্তার এই করুণ দশার ফলে সবচেয়ে বেশি ভুগছে স্কুল-কলেজগামী ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকরা। প্রতিদিন শিশুদের স্কুলে পৌঁছে দিতে অনেক বাবা-মাকে কোলে করে জল-ভরা রাস্তা পার করতে হচ্ছে।

এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করেন। চার-পাঁচটি স্কুল, দুটি কলেজ এবং একাধিক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়ারা এই সড়ককেই একমাত্র ভরসা হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ছোট-বড় গাড়ির চালকরাও প্রতিদিন দুর্ঘটনার আশঙ্কা মাথায় নিয়ে চলাফেরা করছেন।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, বারবার সংবাদপত্রের মাধ্যমে সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে। স্থানীয় বিধায়ক, জেলা পরিষদ সদস্য, পূর্ত বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের কাছে একাধিকবার আবেদন জানানো হয়েছে। এমনকি অসমের মুখ্যমন্ত্রীকেও দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু প্রতি বারই তারা শুধু আশ্বাস পেয়েছেন—কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

এই অবস্থায়, বিক্ষুব্ধ এবং হতাশ জনগণ আর বসে থাকতে চাননি। তাই গত শনিবার শরীফনগর বাজার কমিটি ও সাধারণ জনগণ একত্র হয়ে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেন—এই রাস্তার গর্ত আর ধ্বংসাবশেষ তারা আর সহ্য করবেন না। নিজস্ব অর্থ ও শ্রম দিয়ে, চাঁদা তুলে বাজারের ওই বিপজ্জনক গর্তটি আপাতত ভরাট করে চলাচলের উপযোগী করে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়।

এই মহতী উদ্যোগে নেতৃত্ব দেন বাজার কমিটির সভাপতি আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, সম্পাদক নজরুল ইসলাম, প্রাক্তন গ্রাম পঞ্চায়েত সভাপতি হোসেন আহমেদ চৌধুরী, সমাজসেবী আব্দুল আহাদ, জাবেদুল ইসলাম চৌধুরী, হাসান আলি, আব্দুল মনাফ সহ বহু স্থানীয় যুবক ও প্রবীণ ব্যক্তি। তাঁরা বলেন, “শহর থেকে মাত্র ৩-৪ কিলোমিটার দূরের একটি এত গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা এমন অবস্থায় পড়ে থাকবে—এটা লজ্জার।”

শরীফনগরে চাঁদা তুলে সড়কের গর্ত ভরাট বাজার কমিটি ও গ্রামবাসীর

স্থানীয় জনগণের এই স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগের খবর পৌঁছায় পূর্ত বিভাগের কানেও। তড়িঘড়ি করে বিভাগীয় কর্মী তাপস দাস ও একজন সহকর্মী এসে গোটা রাস্তাটি পরিদর্শন করেন ও ছবি তুলে নিয়ে যান। তাঁরা জানান, রাস্তাটি দ্রুত মেরামতের জন্য বিভাগীয় প্রধানের কাছে হলফনামা পেশ করে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানাবেন।

এছাড়া, এলাকার লোকজন প্রাক্তন মন্ত্রী ও বর্তমান বিধায়ক সিদ্দিক আহমেদের সঙ্গেও ফোনে যোগাযোগ করেন এবং রাস্তাটির ভয়াবহ অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করেন। বিধায়ক আশ্বাস দেন, বিষয়টি বিভাগীয় প্রধানের সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করবেন।

রাস্তাটি মেরামত বা পুনর্নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব বিবেচনা করে এলাকাবাসী শ্রীভূমি জেলার জেলা উপায়ুক্ত, পূর্ত বিভাগের প্রধান, বিধায়ক সিদ্দিক আহমেদ, মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু পাল এবং সর্বোপরি অসমের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী-র হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। তাঁদের আবেদন, এই জনপথে যে চরম দুর্ভোগ চলছে, তা যেন শিগগিরই নিরসন করা হয়।

শরীফনগর বাজার কমিটি ও সাধারণ জনগণের এই প্রয়াস শুধুমাত্র রাস্তা সংস্কারের একটি উদাহরণ নয়—এটি এক গর্বের মুহূর্তও বটে। যখন সরকারি ব্যবস্থাপনা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন সাধারণ মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কিভাবে নিজেদের অধিকার রক্ষা করে, তার জীবন্ত প্রমাণ শরীফনগরের এই ঘটনা।

এলাকাবাসীর এই সংগঠিত প্রচেষ্টাকে অনেকেই প্রশংসা করে বলেছেন,এই উদ্যোগ সরকারকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—আসল উন্নয়ন তখনই হয়, যখন মানুষের সঙ্গে সরকার হাঁটে, মানুষকে নয় ছাঁটে।

Author

Spread the News