বৃহত্তর সোনাইয়ের ‘শিক্ষার আলোকবর্তিকা’ তজমুল আলি মজুমদার
।। মিলন উদ্দিন লস্কর।।
(সাংবাদিক ও সমাজকর্মী)
২৬ ডিসেম্বর : ষাটের দশক। বলতে বাধা নেই, ওই সময়ে গ্রামকাছাড়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ কিংবা উচ্চশিক্ষার সুযোগ ছিল অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ পরিসরে। উচ্চশিক্ষিত খুঁজতে হলে একটি পরগনার দিকে তাকাতে হতো। কিন্তু ওই সন্ধিক্ষণে তারুণ্যে ভরপুর, বৌদ্ধিক ও শৈক্ষিক চেতনায় দীপ্ত, রাজনৈতিকভাবেও সচেতন এক যুবক বৃহত্তর সোনাই অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার এক উন্মুক্ত দ্বার খুলে দিয়েছিলেন। তাঁর অঙ্কুরিত সেই বীজ আজ এক পূর্ণাঙ্গ বৃক্ষস্বরূপ হয়ে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেই চলেছে। তিনি সোনাই অঞ্চল তো বটেই, গোটা কাছাড়ে, পুরো বরাক উপত্যকায় এক সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। নাম হচ্ছে পটল মজুমদার।
বৃহত্তর সোনাই এলাকায় শিক্ষার আলোকবর্তিকা হিসেবে সুপরিচিত তিনি। যাঁকে সবাই পটল মজুমদার হিসেবে চিনেন। তবে পোশাকি নাম হচ্ছে তজমুল আলি মজুমদার। সোনাই উত্তর মোহনপুরে এক অভিজাত পরিবারে ১৯৪৯ সালের ১৪ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ তাঁর। বাবার নাম মছদ্দর আলি মজুমদার। মায়ের নাম আজিবুন নেছা মজুমদার। সোনাই মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তজমুল আলির প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি। পরে ভর্তি হন সোনাই নিত্যগোপাল হাইস্কুলে। স্নাতক অবধি পড়াশোনা শিলচর গুরুচরণ কলেজে। তখন শিলচরের সঙ্গে সোনাইর যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত ছিল না। তাই কলেজের পাশেই কয়েকজন মিলে একটি মেস করে থাকতেন। জিসি কলেজ থেকে কলা বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি গ্রহণ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি গ্রহণের স্বপ্ন নিয়ে তজমুল আলি ১৯৬৯ সালে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। একইসঙ্গে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন সোনাই ইছারপারের আব্দুল হক বড়ভূইয়াও। ওই সময়ে বৃহত্তর সোনাই এলাকায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী দূরবিন দিয়ে দেখতে হতো। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর ইচ্ছে করলে তজমুল আলি মজুমদার কোনও কলেজের অধ্যাপক কিংবা সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সরকারি চাকরির পেছনে দৌড়াদৌড়ি না করে বৃহত্তর সোনাই এলাকার ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার জন্য কীভাবে একটি কলেজ খোলা যায়, তা নিয়ে চিন্তা করলেন। এ নিয়ে তিনি অনেকের সঙ্গে যোগাযোগও করেন। সেই সময়ে ময়ীনুল হক চৌধুরী বরাক তথা অসমে কংগ্রেসের অবিসংবাদিত নেতা। তিনিও কংগ্রেস পরিবারের লোক। দেখা করলেন ময়ীনুল হক চৌধুরীর সঙ্গে। ময়ীনুল হক অবশ্য তাঁকে উৎসাহিত করলেন। ময়ীনুল হকের আশীর্বাদ নিয়ে তজমূল আলি মজুমদার সোনাই এলাকায় উচ্চশিক্ষার বিস্তারে একটি কলেজ স্থাপন করেন।
সোনাই এলাকার সে-সময়ের আরেক জনপ্রিয় ব্যক্তি ডাঃ ইলিয়াস আলি লস্করকে কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি নির্বাচিত করে সোনাই এনজি স্কুলে মর্নিং শিফটে মাত্র কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্রকে নিয়ে কলেজের যাত্রা শুরু হয়। অবশ্য ওই সময় তাঁর পাশে দাড়ান তৎকালীন বিধায়ক নুরুল হক চৌধুরী, ডাঃ সুষেণ নাথ, ডাঃ রুক্মিণী নাথ, রবিজুল আলি লস্কর, শিক্ষাবিদ ইয়ামিন আলি লস্কর, গুলেজর আলি মজুমদার, সে-সময়ের পঞ্চায়েত আসক আলি, প্রাক্তন বিধায়ক শুভঙ্কর সিংহ প্রমুখ। তৎকালীন সোনাই এনজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হামিদ আলি চৌধুরী স্কুলে মর্নিং শিফ্টে অস্থায়ীভাবে কলেজের ক্লাস চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেন। বছর দুয়েকের মধ্যে চাংগুরতলে জমি ব্যবস্থা করে বাঁশ-বেতের কাঠামো তৈরি করে কলেজ স্থানান্তরিত হয়। জমিদাতা মাধবচন্দ্র দাস জমি ও নগদ ৫০ হাজার টাকা দান করায় কলেজের নামকরণ করা হয় এমসিডি কলেজ। এই কলেজের জন্য প্রায় সাত বিঘা জমি দান করেছেন এলাকার কালামণি মজুমদার নামের আরেক সহৃদয় ব্যক্তি। এই কলেজকে প্রাদেশিকীকরণ এবং বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছাতে তজমুল আলি মজুমদারের অবদান অনস্বীকার্য।
এলাকার মানুষের আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল না থাকায় ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে নামমাত্র ফি নেওয়া হতো। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য ব্যয় মেটাতে তজমুল আলি মজুমদার চাঁদার জন্য মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গেছেন। দীর্ঘ ১৪ বছর বিনা বেতনে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বর্তমানে কলেজে বাণিজ্য ও বিজ্ঞান বিভাগও চালু হয়েছে। এই কলেজ থেকেই তিনি অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর নেন। এরপর ২০২১ সাল পর্যন্ত পরিচালন সমিতির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।
তবে পটল মজুমদার কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেওয়ার আগে সূচনাপর্বে কিছুদিন অবৈতনিক অধ্যক্ষ ছিলেন সোনাই এনজি-র শিক্ষক কাজল রায়। নিবন্ধ লেখকের মূল উদ্দেশ্য সোনাই কলেজের ইতিহাস রচনা নয়, ব্যক্তি তজমুল আলি মজুমদারের জীবন আদর্শ ও সমাজজীবনে তাঁর অবদান নিয়ে আলোচনা। সোনাই কলেজ ছাড়াও আরও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালন সমিতির গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তজমুল আলি মজুমদার তাঁর অপ্রকাশিত আত্মজীবনীতে কৈশোর, বাল্যকাল থেকে শুরু করে সমসাময়িক অনেক ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছেন। এতে উল্লেখ করেছেন, সোনাই কলেজ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে বেশ কয়েকজন বিধায়ক হয়েছেন, কিন্তু এই কলেজের উন্নয়নে সবার সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন শুধু প্রয়াত বিধায়ক নুরুল হক চৌধুরী, প্রয়াত কুতুব আহমদ মজুমদার, এনামুল হক লস্কর ও আমিনুল হক লস্কর। তবে শিলচরের সাংসদ সন্তোষমোহন দেব কলেজের উন্নয়নে বিভিন্ন সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
তজমুল আলি মজুমদার শুধু এমসিডি কলেজ নয়, সোনাই অঞ্চলে আরও বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার অন্যতম কারিগর। এগুলো হচ্ছে- গুলেজর আলি মজুমদার এমই স্কুল, মকবুল আলি মজুমদার এমই স্কুল, ঝাঞ্জারবালি এমই স্কুল, হাতিখাল হাইস্কুল, সোনাই এসসি রায় গার্লস হাইস্কুল, হলিলাইট ইংলিশ স্কুল ইত্যাদি। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বহু মন্দির-মসজিদ, ঈদগাহ স্থাপনের সঙ্গেও তিনি জড়িত। তিনি শিলচর বড় মসজিদ কমিটির অন্যতম সহ-সভাপতিও। সোনাই ময়ীনুল হক চৌধুরী প্রেক্ষাগৃহ ও সোনাই বাজারের বড় জামে মসজিদের সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ঐতিহ্যবাহী সোনাই ক্লাব গড়ার সূচনালগ্নে তিনি সভাপতি ছিলেন। তিনি একজন সামাজিক এবং সালিশ ব্যক্তিত্ব হিসেবেও সুপরিচিত। জমি-জায়গা নিয়ে মারামারি হোক বা পারিবারিক কলহ কিংবা অন্য কোনও সামাজিক সমস্যা দেখা দিলে তজমুল আলি মজুমদার, সিরাজ উদ্দিন লস্কর (সিরাই পঞ্চায়েত), আলা উদ্দিন মজুমদার, রবিজুল আলি লস্কর, জালাল উদ্দিন মজুমদাররা মামলা-মোকদ্দমা না করে আপস-মীমাংসা করে দিতেন। এদের অনেকেই প্রয়াত। সোনাই থানায় যখনই যে পুলিশ অফিসার এসেছেন, তাঁরা যে কোনও পরিস্থিতি মোকাবিলায় পটল মজুমদার সহ কয়েকজনের পরামর্শ নিতেন। তিনি একজন সামাজিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও সুপরিচিত। এলাকার হিন্দু কিংবা মুসলিম সমাজের প্রতিটি বিয়ে কিংবা অন্য সামাজিক অনুষ্ঠানে তজমুল আলি মজুমদার অনুপস্থিত, এটা হতে পারে না। পটল মজুমদার একজন উচ্চশিক্ষিত, অভিজাত পরিবার তথা একটি কলেজের অধ্যক্ষ। কিন্তু পদবি কিংবা আভিজাত্য নিয়ে নেই তাঁর কোনও গরিমা। সবার সঙ্গে সাদা মন নিয়ে কথা বলেন। এলাকার ছোট-বড় সবাই তাঁকে ‘পটল স্যার’ সম্বোধন করে কথা বলেন। প্রয়াত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষমোহন দেব যেমন পিতারও ‘রানাদা’, পুত্রেরও ‘রানাদা’, ঠিক সেভাবে সোনাই এলাকায় একবাক্যে সবার কাছে ‘পটল স্যার’। বরাক উপত্যকায় এরকম তৃতীয় কোনও ব্যক্তি নেই, যিনি পিতা-পুত্রের কাছে একই সম্বোধন পেতেন।
তজমুল আলি মজুমদার ছাত্রজীবন থেকে কংগ্রেস রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। কয়েক বছর তিনি সোনাই ব্লক কংগ্রেস সভাপতিও ছিলেন। ১৯৯১ সালে কংগ্রেস দলের প্রার্থী হয়ে বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেন কিন্তু পরাজিত হন। ২০১৬ সালে সোনাই আসন থেকে আমিনুল হক লস্কর বিজেপি প্রার্থী হিসেবে বিধায়ক নির্বাচিত হন। এই সময় আমিনুলের কিছু ব্যতিক্রমী কাজকর্মে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর সভা এবং সরকারি অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকতেন। বিজেপি নেতার সভা-সমিতিতে তজমুল আলির উপস্থিতি নিয়ে অনেক বিরূপ সমালোচনাও হতো। কেউ কেউ তাঁকে ‘পটল শুক্লবৈদ্য’ বলে আড়ালে- আবডালে মন্তব্য করতেন। পটল মজুমদার কিন্তু বিজেপির সদস্যপদ নেননি। শুধু আমিনুলকে ভালবেসে তাঁর সঙ্গে থাকতেন। এখনও আছেন। তজমুল আলি মজুমদার সোনাই এলাকায় এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। তাঁর মৃত্যুর পর হয়তো অনেকেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবেন। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে তাঁর যথার্থ মূল্যায়ন এখনও হয়নি সোনাইতে। অনেক সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানে তাঁকে সভাপতি কিংবা অতিথি করা হয়েছে। কিন্তু একজন কৃতী ব্যক্তি হিসেবে বিশেষ কোনও সম্মাননা জানানো হয়নি। তবে শিলচর ঈদ সম্মিলনী উদ্যাপন কমিটি ও হাজি এসইউ লস্কর এডুকেশনাল ফাউন্ডেশন সোনাই এলাকার শিক্ষার প্রসারে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি জানিয়ে গুণিজন সম্মাননা প্রদান করেছে। দু’টি সংগঠনের সঙ্গে এই নিবন্ধ লেখক যুক্ত।
তজমুল আলি মজুমদারের আমি ছাত্র নই, কিন্তু এক গুণমুগ্ধ। আমার বাবার মৃত্যুর পর এডুকেশনাল ফাউন্ডেশন গড়ে প্রথম বছরই তাঁকে শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘শিক্ষার আলোকবর্তিকা’ হিসেবে গুণিজন সম্মাননা জানাই। এর দু’বছর পরই তাঁকে ফাউন্ডেশনের সভাপতি নির্বাচিত করে তাঁর পরামর্শে টানা আট বছর কাজ করি। শারীরিক অসুস্থতার দরুন তাঁকে সভাপতি থেকে অব্যাহতি দিয়ে উপদেষ্টা হিসেবে রাখা হয়। শিলচর ঈদ সম্মিলনী উদ্যাপন কমিটিও ২০১৫ সালে জেলা গ্রন্থাগার ভবনে গুণিজন সংবর্ধনা দেয় পটল মজুমদারকে। এটাই তাঁর বড়মাপের সংবর্ধনা। বছর খানেক ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত কিছু উপশমের দরুন বাড়ি থেকে খুব একটা বের হন না। কিন্তু মোবাইলে পরিচিতজনদের সঙ্গে কথা বলেন। দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ-এর সম্পাদক তৈমুর রাজা চৌধুরী ও আমাকে তিনি ভীষণ স্নেহ করেন। এই তো কয়েকদিন আগে শিলচরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় খোঁজ নিতে গেলে আমাদের দেখে তিনি আবেগ প্রবণ হয়ে ওঠেন। গত এপ্রিল মাসে সোনাই এনজি স্কুলের এক কৃতী প্রাক্তনীকে সংবর্ধনা সভার অন্যতম উদ্যোক্তা নিবন্ধ লেখক। স্যারকে বললাম, সভাপতিত্ব আপনাকেই করতে হবে। অসুস্থ শরীর নিয়ে সভা শুরুর অনেক আগেই উপস্থিত। যে কোনও সভা কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে সময়মতো হাজির হওয়া এটা তাঁর একটা ব্যতিক্রমী গুণ। সোনাইবাসী যে কয়েকজন মানুষকে নিয়ে গর্ব করতে পারেন, তার মধ্যে তিনি অন্যতম। তজমুল আলি মজুমদার বিভিন্ন সভা-সমিতি কিংবা বৈঠকী আলোচনায় স্বগর্বে বলে থাকেন, তিনি যখন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন, তখন সোনাই অঞ্চলে হাতে গোনা কয়েকজন ছিলেন। সোনাইতে কলেজ হওয়ার পর আজ ঘরে ঘরে স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। এটাই তাঁর আত্মসন্তুষ্টি। (এর আগে সাময়িক প্রসঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে)