ঐক্যবদ্ধ হলে কংগ্রেসের লড়াই জমতে পারে, ভাঙন ঘটলে বিজেপির হ্যাটট্রিক প্রায় নিশ্চিত পাথাকান্দিতে, অভিমত
মোহাম্মদ জনি, পাথারকান্দি।
বরাক তরঙ্গ, ৮ অক্টোবর : আসন্ন ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনকে ঘিরে শ্রীভূমি জেলার পাথারকান্দি আসন এখন রাজ্যের অন্যতম আলোচিত রাজনৈতিক কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। একদিকে দীর্ঘদিন জনসংযোগ থেকে দূরে থাকা প্রাক্তন বিধায়ক কার্তিক সেনা সিনহা আবারও রাজনীতির ময়দানে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, অন্যদিকে দুইবারের বিধায়ক এবং বর্তমান রাজ্য সরকারের মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু পাল নিজের শক্ত ঘাঁটিকে অটুট রাখার লড়াইয়ে নামবেন এবার কৃষ্ণেন্দুকে দিয়েই হ্যাটট্রিকের পথে হাটছে বিজেপি।ফলে এবারও এই আসনটি ঘিরে রাজনৈতিক মহলে উত্তেজনা তুঙ্গে।
একটি সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসের ১০ তারিখে গুয়াহাটিতে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি গৌরব গগৈ-এর হাত ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসে যোগ দেবেন কার্তিক সেনা সিনহা। তিনি অতীতে পাথারকান্দি থেকে বিধায়ক ছিলেন, তবে গত এক দশকের অধিক সময় রাজনীতির মূলধারার বাইরে থাকায় স্থানীয় সমর্থকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অনেকটাই শিথিল হয়ে পড়ে। এবার তাঁর ফেরা কংগ্রেসের সংগঠনে নতুন প্রাণ সঞ্চার করবে নাকি দলে ভাঙন ধরাবে এই প্রশ্ন এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
পাথারকান্দি ২০১৬ সাল থেকে বিজেপির অটল ঘাঁটি। এই আসন থেকে কৃষ্ণেন্দু পাল টানা দুইবার নির্বাচিত হয়ে শুধু ইতিহাসই গড়েননি, বরং রাজ্যের মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্বও পেয়েছেন। বর্তমানে তিনি মৎস্য, পশুপালন, ভেটেরিনারি এবং পূর্ত দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর সংগঠনিক দক্ষতা, স্থানীয় জনসংযোগ, এবং উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে এলাকায় তাঁর প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। ফলে আসন্ন নির্বাচনে কংগ্রেসের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে কৃষ্ণেন্দু পালকে টেক্কা দেওয়া। দল সংগঠন জনসংযোগ অর্থ বল জনবল সব রয়েছে কৃষ্ণেন্দু হাতে মুঠয়।
কংগ্রেস শিবিরে কার্তিক সেনা সিনহার প্রত্যাবর্তনকে কেন্দ্র করে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। একদিকে দলের একটি অংশ মনে করছে, অভিজ্ঞ এই নেতাকে দলে নিলে কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্ক মজবুত হবে; অন্যদিকে অনেক স্থানীয় নেতা-কর্মী শঙ্কা প্রকাশ করছেন যে,আবার অনেকের মতে কংগ্রেস দলের দূরদিনের সময় দলের অস্তিত্ব পাথারকান্দিতে ধরে রাখতে ও দীর্ঘদিন সক্রিয় থেকে সংগঠনকে টিকিয়ে রাখা পুরনো কর্মীরা যদি উপেক্ষিত হন, তাহলে ভেতরের ক্ষোভ বেড়ে যেতে পারে।
বিশেষত প্রতাপ সুনহা পিপু-র নেতৃত্বে কংগ্রেসের পুরনো কমী ও যুবশক্তি বিগত কয়েক বছরে তৃণমূল পর্যায়ে সক্রিয় থেকেছে। তাঁদের অবদানকে অগ্রাহ্য করে টিকিট যদি সরাসরি কার্তিক সেনাকে দেওয়া হয়, তাহলে পুরনো ও যুবকর্মীদের অসন্তোষ ভোটের ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কেননা ২০২১ এর নির্বচনে দলীয় মনোনয়নের আবেদন করলেও তাকে টিকিট না দিয়ে চা- বাগান সম্পদায়ের যুবক শচীন সাহুকে দল মনোনয়ন প্রদান করে এবং বিজেপি প্রার্থী কৃষ্ণেন্দু পালের কাছে পরাজিত হয়ে পরবর্তী কংগ্রেস ত্যাগ করে মুখ্যমন্ত্রী ড. হিমন্ত বিশ্ব শর্মা হাত ধরে বিজেপি দলে ভিড়েন শচীন সাহু। প্রতাব সিনহা উপর দিয়ে রাজনীতি অজস্র ঝড় বয়ে গেলেও তিনি কংগ্রেস ছেড়ে না গিয়ে দলকে খাদের মুখ থেকে টেনে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ২৬ এর নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছে রয়েছে তার। তাই তিনি জনসংযোগ সহ সংগঠনকে ঢেলে সাজাতে দিন রাত কাজ করে যাচ্ছেন। এরমধ্যে হঠাৎ করে উড়ে এসে জোড়ে বসা কাউকে দল টিকিট যদি প্রদান করে তা হলে দলীয় টিকিট প্রত্যাশী সহ পুরোনো কর্মীদের মধ্যে দলীয় কোন্দল দেখা দেওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এই প্রক্ষাপটে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন কংগ্রেস যদি রাজনীতি ব্যাপারি কার্তিক সেনা সিনহাকে পুরনো কর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় ঘটিয়ে মাঠে নামাতে পারে, তবে বিজেপির শক্ত ঘাঁটিতে অন্তত একটি শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলা সম্ভব। তবে দলে ঐক্যহীনতা থাকলে বিজেপির বিপরীতে লড়াই অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়বে। কৃষ্ণেন্দু পালের জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক শক্তির কারণে তাঁকে হারাতে হলে কংগ্রেসকে এককেন্দ্রিক ঐক্য গড়ে তুলতেই হবে।
পাথারকান্দি রাজনৈতিকভাবে সবসময়েই সংবেদনশীল আসন হিসেবে পরিচিত। একসময় কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি হলেও বর্তমানে কৃষ্ণেন্দুর চতুর নেতৃত্বে বিজেপি এখানে প্রভাবশালী। কংগ্রেসের সামনে তাই দ্বৈত চ্যালেঞ্জ ভেতরের অসন্তোষ দমন করে ঐক্য বজায় রাখা। শক্তিশালী বিজেপি প্রার্থীর মোকাবিলা করার মতো বিকল্প কৌশল তৈরি করা।
কার্তিক সেনা সিনহা দলে যোগ দিলে নতুন সমীকরণ তৈরি হলেও তাঁর গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করবে স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক এবং দলীয় কর্মীদের আস্থার উপর।
সব মিলিয়ে বলা যায়, পাথারকান্দি এখন রাজ্য রাজনীতির সবচেয়ে আলোচিত মঞ্চে পরিণত হয়েছে।বিজেপির অটল ঘাঁটি ও মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু পালের জনপ্রিয়তা প্রাক্তন বিধায়ক কংগ্রেসে কার্তিক সেনার কংগ্রেসে আগমন, দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী পাথারকান্দি ব্লক কংগ্রেস সভাপতি প্রতাব সিনহা পিলু যুব নেতৃত্ব ও পুরনো কর্মীদের ভূমিকা,এই সমস্ত উপাদান একসঙ্গে আসন্ন ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আগে থেকেই পাথারকান্দিকে এক রোমাঞ্চকর রাজনৈতিক লড়াইয়ের মঞ্চে পরিণত করছে।
রাজনৈতিক মহলের অভিমত, কংগ্রেস যদি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে তবে পাথারকান্দিতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু ভেতরে ভাঙন দেখা দিলে বিজেপির জয় প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠবে। আসন্ন ২০২৬ সালের নির্বাচনে বিজেপি তাদের শক্ত অবস্থান আরও একবার স্পষ্ট করে দিয়েছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ড. হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সম্প্রতি পাথারকান্দি সফরে এসে এক ভরা জনসভায় ঘোষণা করে গেছেন দল আবারও কৃষ্ণেন্দু পালকেই টিকিট দেবে। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুধু বিজেপি কর্মীদের মনোবলই চাঙা হয়নি, বরং বিরোধীদের কাছেও পরিষ্কার বার্তা গেছে পাথারকান্দিতে বিজেপি তাদের সংগঠন ও প্রভাব ধরে রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।এখন এটা স্পষ্ট পাথারকান্দি কেন্দ্রে ২০২৬ বিধানসভা নির্বাচন ঘিরে জমছে নতুন সমীকরণ। কংগ্রেসে প্রাক্তন বিধায়ক কার্তিক সেনা সিনহার প্রত্যাবর্তন একদিকে কার্তিক ঘনিষ্ঠদের মনে নতুন উদ্দীপনা জাগাচ্ছে,যেমন তেমনি পুরনো দলীয় কর্মীদের মনে ক্ষোভের পারদ চড়ছে। অন্যদিকে বিজেপির ভরসা রয়ে গেছে জনপ্রিয় ও কর্মতৎপর মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু পালের দাপটে। রাজনৈতিক মহলের অভিমত, কংগ্রেস যদি ভেতরে ঐক্য বজায় রাখতে পারে, তবে আসনটিতে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। কিন্তু যদি ভাঙন দেখা দেয়, তবে বিজেপির টানা হ্যাটট্রিক জয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে যাবে।সব মিলিয়ে, ২০২৬ সালের নির্বাচন পাথারকান্দিকে রাজ্য রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার প্রবল সম্ভাবন তৈরি করেছে।