এবার উনিশ উদযাপনের উন্মাদনা অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে

।। প্রদীপ দত্ত রায় ।।
(লেখক প্রাক্তন ছাত্রনেতা ও গৌহাটি হাইকোর্টের আইনজীবী)
২৯ মে : বরাকের ভাষা শহিদ দিবস ১৯ মে উদযাপন এবার ভিন্নমাত্রা এনে দিয়েছে। এ দিবস উদযাপনে এবার অভূতপূর্ব সাড়া দেখা গেছে। কেবল শিলচর নয় বরাক উপত্যকার বিভিন্ন জায়গায় গ্রামেগঞ্জে দিনটি নানা অনুষ্ঠানসুচিতে উদযাপন করা হয়। আগে এত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি। কয়েক বছর যাবৎ ১৯ এর আবেগ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। এবার কেবল বরাক উপত্যকায় নয়, কলকাতা, আসানসোল, পাটনা, নয়াদিল্লি, মুম্বাই এবং প্রথমবারের মতো শিলিগুড়িতে এই দিবস উদযাপন করা হয়েছে।অসম রাজ্যের বিভিন্ন শহরে ভাষা শহিদ দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়েছে। কেবল তাই নয় বিদেশের মাটিতেও এবার উনিশ উদযাপন হয়েছে। জাপানের হিরোশিমা নগরীতে পর্যন্ত এই দিবসটি উদযাপিত হয়েছে। তাছাড়া নিউইয়র্ক, লন্ডন, ঢাকা ইত্যাদি জায়গাতে এবারো অনুষ্ঠান ছিল। বাংলা ভাষার মর্যাদার রক্ষার জন্য এই আন্দোলন যে কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষের নয়। এটা যে সার্বিকভাবে বাঙালি জনগোষ্ঠীর এই উপলব্ধিটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে। আগে ১৯ মে ভাষা শহিদ দিবস নিয়ে তেমন ভাবে প্রচার বা প্রসার ছিল না।  ফলে দীর্ঘদিন দেশের অন্যান্য অংশের মানুষ জানতেই পারেনি এই দিবসের কথা। শিলচরে ভাষার অধিকার রক্ষার আন্দোলনে একাদশ শহিদ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। ১৯৬১ সালে শিলচর রেলস্টেশনে বিনা প্ররোচনায় পুলিশ গুলি চালালে সত্যাগ্রহীদের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু এই দিনটি কেবলমাত্র তারাপুর রেল স্টেশন, শিলচর শ্মশানঘাট এবং গান্ধীবাগে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করেই শেষ হয়ে যেত। এবার পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে।। তবে এই দিবসের তাৎপর্য জনসমক্ষে তুলে ধরার ক্ষেত্রে ২০০০ সালে গঠিত ১৯ মে উদযাপন সমিতির গুরুত্ব রয়েছে। কারণ , ওই বছরই শিলচর শহরে বিশাল শোভাযাত্রা আয়োজন করা হয়েছিল। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা এতে অংশ নিয়েছিল এবং চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বিদেশ থেকেও প্রতিনিধিরা এসেছিল। এরপর থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও ভাষা প্রেমী জনসাধারণ ১৯ মে-র অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নিয়মিত আসছেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ সহ মাতৃভাষা সুরক্ষা সমিতি, বরাকবঙ্গ, ভাষা শহিদ স্মারক সমিতি, ভাষা শহিদ স্টেশন দাবি কমিটি,  ১৯ মে উদযাপন কমিটি ছাড়াও নানাস্থানে শহিদ বেদীকে কেন্দ্র করে সংক্ষিপ্ত পরিষদে হলেও এই দিবসটি উদযাপনের আয়োজন করা হচ্ছে আজকাল।

কিভাবে তৈরি হয় ১৯ মে-র প্রেক্ষাপট। এ নিয়ে এই পরিসরে একটু আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। ১৯৬০ সালের ২৪ অক্টোবর অসম বিধানসভায় ভাষা আইন পাস হয়ে যায়। সারা রাজ্যে একমাত্র অসমীয়া ভাষা মাধ্যম হিসেবে প্রচলিত থাকবে এমন প্রস্তাব  ছিল ওই আইনে। এর আগে শিলচরে  ঐতিহাসিক ভাষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষার মর্যাদা রক্ষায় যে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল তাতে কর্ণপাত করেনি রাজ্য সরকার। তৎকালীন অসমের পার্বত্য অঞ্চলের নেতৃবৃন্দের কোনো প্রতিবাদে  ভ্রুক্ষেপ করেননি বিধানসভার তৎকালীন সদস্যরা। অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে আইন পাস হয়ে যায়। যে গোয়ালপাড়া জেলা পশ্চিমবঙ্গের অংশ ছিল তাকে অসমে এনে জুড়ে দেওয়া হয়েছে সেখানেও অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার পথ প্রশস্ত হয়ে যায়। পার্বত্য অঞ্চলের নেতারা শংকিত হয়ে পড়েন। এই অসমিয়া প্রভূত্ববাদের বিরুদ্ধে গারো পাহাড়, খাসি পাহাড় ,জয়ন্তিয়া পাহাড়, নাগা পাহাড়, মণিপুর, লুসাই পাহাড় ইত্যাদিতে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়। সীমিত  পরিমাণ হলেও কার্বি  আংলং এবং উত্তর কাছার পার্বত্য অঞ্চলেও প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। পার্বত্য জনজাতিদের মতামতকে উপেক্ষা করার এই সিদ্ধান্ত কেউ মেনে নিতে পারেননি। তৎকালীন অবিভক্ত কাছাড়ে এর ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। কারণ, কাছাড় সিলেটের মতোই বঙ্গপ্রদেশ থেকে অসমে সংযোজিত অংশ। এই অঞ্চলের মানুষ বাংলাভাষী ফলে একক অসমীয়া ভাষা নীতি এ অঞ্চলের মানুষ মেনে নিতে পারেননি। এই অঞ্চলেও অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হতে পারে এই আশঙ্কা থেকে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।

অসম সরকারের জোর করে ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার একপেশে নীতি গ্রহণের বিরুদ্ধে  তৎকালীন কাছাড়ের মানুষ গর্জে ওঠেন।  ন্যায্য গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হওয়ার চিন্তায় তখন মানুষের মধ্যে লড়াই করার একটা মানসিকতা তৈরি হয়ে যায়। স্লোগান উঠে, ‘জান দেব তবু জবান দেব না।’  বিধানসভায় ভাষা আইন পাস হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি করিমগঞ্জের রমনী মোহন ইনস্টিটিউটে কাছাড় জেলা গণসম্মেলন আহবান করা হয়।  সেই সভার পর কাছাড় জেলার তিনটি মহকুমায় ভাষা আন্দোলনের জন্য কমিটি গঠন করা হয়। ১৫ দিনের মধ্যে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে শতাধিক সভা করে ভাষা আন্দোলনের শপথ গ্রহণ করা হয়। এই আন্দোলনে সকল শ্রেণির জনগণের সমর্থন আদায়ের জন্য ভাষা আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক পরিতোষ পাল চৌধুরীর নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ কাচারে গ্রামে গ্রামান্তরে পদযাত্রা  করেন। শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র সবাইকে এক সূত্রে গাঁথার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে চলেন ভাষা আন্দোলনের সেনানিরা। এরপর ১৯ মে রেল অবরোধের ডাক দেওয়া হয়। সত্যাগ্রহীরা গণতান্ত্রিক উপায়ে রেললাইনের উপর বসে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। সত্যাগ্রহীরা অচল করে দেন জেলা প্রশাসন সমস্ত কার্যালয়। আন্দোলনে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান দেখে প্রশাসনিক কর্তাদের মাথা খারাপ হয়ে যায় । শিলচরে তারা তখন তিনটি অস্থায়ী কারাগার তৈরি করে সত্যাগ্রহীদের নিয়ে তাতে ভরতে থাকে। শিলচর রেল স্টেশনে তখন সত্যাগ্রহীদের আন্দোলন শেষ পর্যায়ে। কর্তব্যরত সশস্ত্র প্রহরীরা এমন শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দেখে অবাক। বেলা তখন ২-৩৫ মিনিট উপোর মহল থেকে নির্দেশ এল তারপর সশস্ত্র বাহিনী সত্যাগ্রহীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুটতে শুরু করল। একদল শুয়ে পড়ে নিজেদের গুলি আঘাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেও আরেক দল বুক চিতিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। পুলিশের গুলিতে ঝাজরা হয়ে গেল কমলা ভট্টাচার্য, শচীন্দ্র পাল, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, কুমুদ রঞ্জন দাস , কানাইলাল নিয়োগী, সুকমোল পুরকায়স্থ, সুনীল সরকার, হিতেশ বিশ্বাস, তরণী দেবনাথ, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সত্যেন্দ্র দেবের শরীর।  নিজের বুকের রক্তে ভাষা জননীর পূজা করে গেছেন এই একাদশ শহিদ। বিশ্বের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে গেছেন নিজেদের আত্ম বলিদানের ইতিহাস।পরিস্থিতি সবদিক থেকেই বিগড়ে যাওয়ায় আসাম সরকার বাধ্য হয়ে ভাষায় বিল প্রত্যাহার করে আবার তা সংশোধিত আকারে পেশ করে। সংশোধিত বিলে বরাক উপত্যকার সরকারি ভাষা বাংলা স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং অসমের বাকি অংশে অসমিয়া।

বরাকের ভাষা আন্দোলনের যে ইতিহাস রয়েছে তাকে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে কখনোই মান্যতা দেওয়া হয়নি। আন্দোলনের দীর্ঘ বছর পরও শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত সত্যাগ্রহীদের শহিদ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। বরাকের ভাষা শহিদদের জন্য শিলচর রেলওয়ে স্টেশনকে ভাষা শহিদ স্টেশন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন যাবত দাবি জানিয়ে আসা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছে। রেল মন্ত্রক প্রস্তাবের অনুমোদন চেয়ে রাজ্য সরকারকে চিঠি লিখেছিল কিন্তু রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এর কোন ইতিবাচক সাড়া এখনও দেওয়া হয়নি। রেলওয়ে স্টেশনের নাম ভাষা শহিদ স্টেশন করার পক্ষে জনমত রয়েছে। কোনো জনগোষ্ঠীর মানুষকে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে দেখা যাচ্ছে না। ভাষা শহিদ স্টেশন নামকরণে প্রস্তাব অনুমোদন করলে যদি ভাষা শহিদদের স্বীকৃতি দিতে হয় সেই ভয়েই রাজ্য সরকার  পদক্ষেপ করছে না,  এটা ধরে নিতে অসুবিধা হয় না। বরাকের মানুষ এটাও উপলব্ধি করতে পারছে। তবে এবার অসম সাহিত্য সভার সভাপতি বসন্তকুমার গোস্বামী শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করার পর ভাষা শহিদ স্টেশন করার দাবিটি যথাস্থানে পৌঁছে দেবেন বলে জানিয়েছেন। এবং তিনি এই দাবিকে সমর্থন করেছেন। তার এই উদার মনভাবে মর্যাদা দিয়ে রাজ্য সরকার এই দাবিটি অনুমোদন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটা করা হলে বরাক ব্রহ্মপুত্র সমন্বয়ের জন্য যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেক্ষেত্রে এই পদক্ষেপ কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে।

বরাকের ভাষা আন্দোলনকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়া না হলেও অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার স্বপক্ষে মতামত তুলে ধরেছেন। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ গান্ধীবাগে শহিদদের পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করে বলেছিলেন, শহিদদের স্বীকৃতি এখনো দেওয়া হয়নি এটা তো আমার জানা নেই। আমি গিয়ে দেখি কি করা যায়। অবশ্য দিসপুর পৌছার পর তিনি ভাষার শহিদদের কথাটা বেমালুম ভুলে গেছেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা-মন্ত্রীরা গান্ধীবাগে এসে শহিদ দিবসের শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। কিন্তু সরকারিভাবে এই দিবসের স্বীকৃতি আদায়ের প্রতিবন্ধকতা  দূর করতে কেউ উদ্যোগ নেননি।  তবে ইদানিং অবস্থার কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। বরাকের মানুষকে দূরে সরিয়ে রেখে রাজ্যের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয় , এই উপলব্ধিটা দিসপুরের শাসকদের মধ্যে জাগতে শুরু করেছে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সংখ্যাগুরু মানুষ তারাও এখন উপলব্ধি করতে পারছেন যে বিভাজনের রেখা টেনে মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করার দিন এখন শেষ। সমন্বয়ের পথে  রাজ্যকে নতুন দিশা দেখাতে হবে। সেজন্যই অসম সাহিত্য সভার মত অসমের এক অগ্রগণ্য সংগঠন যার গ্রহণযোগ্যতা অসমীয়া সমাজে সব থেকে বেশি সেই সংগঠনের সভাপতি ভাষা শহিদ দিবস উপলক্ষে বরাক সফরে এসে সমন্বয়ের বার্তা দিয়েছেন। এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার উদ্যোগকে খোলা মনে গ্রহণ করা উচিত। তবে তার সঙ্গে এবার 19 মে গুয়াহাটির বাংলা সাহিত্য সভার যে কর্মকর্তারা এসেছিলেন। তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। এর অবসান হওয়া প্রয়োজন। বরাকের ভাষা আন্দোলনকে যদি স্বীকৃতি দেওয়া হয় তাহলে দুই উপত্যকার মধ্যে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুদের মধ্যে যে বিভাজন রেখা তৈরি হয়েছে তা সহজে মিটিয়ে ফেলা সম্ভব। এ কাজে রাজ্য সরকারকে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তবে ১৯ মে ভাষা শহিদ দিবস যেভাবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে আমি আশাবাদী ভাষারই চেতনা মানুষকে ধর্ম নির্বিশেষে এক সূত্রে বেঁধে রাখতে সক্ষম হবে। এবারের অনুষ্ঠানের উদ্দীপনা এরই যেন ইঙ্গিত বহন করছে।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Author

Spread the News