অসম সাহিত্য সভার বরাক সফর সমন্বয়ের এই যাত্রা কাঙ্ক্ষিত পথে যাবে তো?
।। প্রদীপ দত্ত রায় ।।
(লেখক প্রাক্তন ছাত্রনেতা ও গৌহাটি হাইকোর্টের আইনজীবী)
২২ মে : অসম সাহিত্য সভার সভাপতি বসন্তকুমার গোস্বামীর নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল তিন দিনের বরাক সফল শেষ করে গেলেন। প্রতিনিধি দলটি হাইলাকান্দি, শ্রীভূমি এবং শিলচরে সফর করেছে। রাজ্যের দুই উপত্যকার মধ্যে সমন্বয় গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে তাদের এই যাত্রা, এমন আভাস পাওয়া গেছে। ভাষা আন্দোলনের এত বছর পর অসমের সবচেয়ে বড় সাহিত্য সংগঠন বরাক সফরে এসে ভাষা শহিদদের স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে যে পদক্ষেপ করলেন তা এই উপত্যকার মানুষের হৃদয়ে ভাষা আন্দোলনের সময় যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল তাতে কিছুটা হলেও প্রলেপ ফেলতে সক্ষম হয়েছে। উপত্যকার সচেতন মানুষ অসম সাহিত্য সভার পদাধিকারীদের ইতিবাচক মনোভাবকে সাদরেই গ্রহণ করছেন। কারণ, এর আগে সমন্বয়ের বদলে সংঘাতের পরিবেশ জীইয়ে রাখতেই সবাই সচেষ্ট ছিলেন। তবে সমন্বয়ের এই যে যাত্রা তা কাঙ্খিত পথ খুঁজে পাবে তো এ প্রশ্নটা আমার মনে জেগেছে কয়েকটি ঘটনা থেকে। এ বিষয়ে পরে আলোচনা করছি। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এই উপত্যকার মানুষ সমন্বয়ের এই যাত্রায় নিজের মর্যাদা রক্ষা করেই শামিল হতে পারেন। এক্ষেত্রে কোন কিছুই বিসর্জন যাতে দেওয়া না হয়।
১৯৬১ ভাষা আন্দোলনের সময় উনিশ মে শিলচর রেল স্টেশনে পুলিশের গুলিতে ১১ জন তরুণ-তরুণী শহিদ হয়েছিলেন। সেজন্যই শিলচর রেলস্টেশন কে ভাষা শহিদ স্টেশন হিসেবে নামকরণের দাবি দীর্ঘদিনের। এ দাবিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্র এবং রেল মন্ত্র সিলমোহর দিলেও রাজ্য সরকার এতে সায় না দেওয়ায় বিষয়টি ঝুলে রয়েছে। রেলমন্ত্রক রাজ্য সরকারের কাছে স্টেশনটির নামকরণের জন্য কিভাবে তা লেখা হবে শুধু সেটা জানতে চেয়েছিল। কিন্তু রাজ্য সরকার রেলমন্ত্রকের এই চিঠির কোনো জবাব দেয়নি। পরবর্তীকালে দেখা গেছে কোনও এক ভূতুড়ে সংগঠনকে দিয়ে এই দাবির বিরুদ্ধে কথা বলানো হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বরাক উপত্যকার যেকোন ভাষিক গোষ্ঠীর মানুষ এই দাবির পক্ষে রয়েছেন সবাই চান শিলচর রেলস্টেশনের নাম ভাষা শহিদ স্টেশন রাখা হোক। অসম সাহিত্য সভার প্রতিনিধি দল এই দাবিকে সমর্থন করেছেন। শহিদ বেদীতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদনের পর সাহিত্য সভার সভাপতি বসন্তকুমার গোস্বামী বলেছেন তিনি এই দাবি যাতে পূরণ করা হয় সেজন্য রাজ্য সরকারের সঙ্গে কথা বলবেন। তার এই ইতিবাচক মনোভাব খুবই অনুপ্রেরণাদায়ক। রেলস্টেশনের নামাকরণ নিয়ে কোনো ধরনের রাজনৈতিক মতপার্থক্য নেই। থাকার কথা নয়। রেলস্টেশনের নামকরণ হলে তা এই উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেওয়া হবে। কারণ, বিশ্বের কোথাও ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য আন্দোলনে এত জন শহিদ হননি। তাই এই দাবিটি পূরণ যথার্থ এবং সুস্থ মানসিকতার পরিচয় বহন করবে।
অসম সাহিত্য সভার প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বাংলা সাহিত্য সভা অসমের এক প্রতিনিধি দল ও ভাষা শহিদ দিবসকে উপলক্ষ করে এ অঞ্চল সফরে আসে। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এ প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভায় রাজ্যের বৃহত্তর স্বার্থে সমন্বয়ের ক্ষেত্রটি সুদৃঢ় করে তোলার ইচ্ছা প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন বসন্তকুমার গোস্বামী। একটি সাহিত্য সভার সভাপতি হিসেবে যে ধরনের বক্তব্য রাখার কথা তিনি ঠিক সেরকমই বক্তব্য রেখেছেন। তার বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক জন্ম নেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। তার সদিচ্ছা সম্পর্কেও সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। কিন্তু বাংলা সাহিত্য সভা অসমের কর্মকর্তা প্রশান্ত চক্রবর্তী বক্তব্য রাখতে উঠে বলেন, আসাম বিশ্ববিদ্যালয় আসাম আন্দোলনের ফসল। ব্যাস, এতেই সভার তাল কেটে যায়। বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে এখান থেকে। প্রশান্তের এই বক্তব্য পুরনো ঘাকে খুঁচিয়ে নতুন করে ঘা তৈরির অপচেষ্টা বলা যায়। যদিও ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অশোক সেন তার বক্তব্যকে খণ্ডন করে বলেছেন, আসাম বিশ্ববিদ্যালয় আসাম আন্দোলনের কোন ফসল নয়। এ অঞ্চলে মানুষের জন্য পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তারই ফসল আসাম বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি বলেন, সত্য ইতিহাসকে চেপে রাখা ঠিক নয়। তার বক্তব্য নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত হলে প্রশান্ত চক্রবর্তী বলেছেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয় অসম আন্দোলনের ফসল এ কথাটা নাকি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোণোয়াল বলেছিলেন। তাঁর এই বক্তব্য ভুল তথ্য নির্ভর। তাই এটাকে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা যুক্তিসঙ্গত নয়। প্রশান্ত এও বলেছেন তিনি অসম সরকারের ওয়েবসাইট থেকে এই তথ্য সংগ্রহ করেছেন। আমরা জানি ইদানিং অন্য কোনও কোনও সংগঠনের কতিপয় ব্যক্তিকে আসাম বিশ্ববিদ্যালয় আসাম আন্দোলনের ফসল বলে বক্তব্য রাখতে দেখা গেছে। তারা আসাম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য বরাকে যে গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল এই ইতিহাসটাকে মুছে দিতে চাইছে। এবং নতুন করে শিলচরের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় আসাম আন্দোলনের ফলে গড়ে উঠেছে এটা প্রতিষ্ঠা করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এ ধরনের বক্তব্য বরাকের মানুষের স্বাভিমানে আঘাত হানছে।
বরাক উপত্যকার মানুষ জানেন অসম আন্দলনের সময় এ উপত্যকার ছাত্রছাত্রীদের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার দু’টি বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা করতে গিয়ে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। প্রাণের ভয়ে অনেকে পড়াশোনা অর্ধেক রেখে ফিরে আসতেও বাধ্য হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বরাক উপত্যকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন একান্ত প্রয়োজন হয়ে দেখা দেয়। ১৯৮৩ সালে শিলচর আইন মহাবিদ্যালয় বরাক উপত্যকার প্রতিটি কলেজের ছাত্র প্রতিনিধিদের এক বৈঠকে ধারা সারা কাছাড় ছাত্র সংস্থা বা আকসা নামে ছাত্র সংগঠনের জন্ম লাভ হয়। এই সংগঠনের উদ্দেশ্যই ছিল এখানে একটি পৃথক কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা। আমাকে (প্রদীপ দত্তরায়) ওই সভায় আকসার সভাপতি দায়িত্ব অর্পণ করা হয় তারপর উপত্যকার নানা স্থানে একাধিক সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। আকসার আন্দোলনের তীব্রতা দেখে তৎকালীন সাংসদ সন্তোষ মোহন দেব পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে বলেছিলেন এখানে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় করা সম্ভব নয়, তবে রাজ্য স্তরের বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়া উচিত। কিন্তু আন্দোলনকারীরা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে অনড় থাকেন। এই দাবির প্রতি দলমত নির্বিশেষে, জনগোষ্ঠী নির্বিশেষে সকল মানুষ যখন সমর্থন দিতে শুরু করেন তখন সন্তোষমোহন দেব প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন , আমার অঞ্চলের মানুষ যখন পৃথক কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় চাইছে তখন আমিও এই দাবি থেকে সরে থাকতে পারি না। পরবর্তীকালে রাজীব গান্ধী যখন শিলচরে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুর করেন। তখন অসম গণ পরিষদ দলের সাংসদরা সংসদে দাঁড়িয়েই এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ছাত্র সংগঠন আসু এর বিরোধিতা করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিলান্যাসের দিন অসম বনধের ডাক দিয়েছিল এই ছাত্র সংগঠন। ফলে জটিলতার অবসান ঘটাতে কেন্দ্র বাধ্য হয়ে তেজপুরে আরেকটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুর করে। তবে শিলচরে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুর হওয়ার পরেই তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়া নিজে উদ্যোগ নিয়ে জমির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন যখন গড়ে ওঠে তখন বড়ো ছাত্র সংস্থা আবসু এই দাবিকে পূর্ণ সমর্থন জানায়। আকসাও আবসুর পৃথক রাজ্যের দাবিকে সমর্থন জানায়। শিলচরে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুর হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন জানায় এক কোটি জনসংখ্যার কম কোন অঞ্চলকে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেওয়া সম্ভব নয়। তখন আবসু বড়ো অধ্যুষিত অঞ্চলের ৪০ লক্ষ মানুষের সমর্থনের কথা ঘোষণা করে একই সঙ্গে ত্রিপুরা এবং মিজোরাম রাজ্য এই দাবিকে সমর্থন করে চিঠি দেয়। এরপরই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার ক্ষেত্রে জটিলতার অবসান ঘটে। এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পর ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে অসমিয়া এবং বড়ো ছাত্ররা এখানে পড়তে আসে। এখানকার পরিবেশ শান্তিপূর্ণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নত হওয়ায় তারা এটি বিশ্ববিদ্যালয়কেই বেছে নেয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় অসমীয়া সাবজেক্ট চালু যে দাবি তোলা হচ্ছে এ প্রসঙ্গে বলে নেওয়া ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিফু ক্যাম্পাসে ইতিমধ্যেই অসমিয়া সাবজেক্ট চালু রয়েছে। এখানে শিলচর ক্যাম্পাসে অসমিয়া সাবজেক্ট চালু করা যাচ্ছে না কারণ এ অঞ্চলের কোনও কলেজেই অসমীয়া সাবজেক্ট নেই কাজেই এই সাবজেক্টে ছাত্রছাত্রীদের চাহিদা নেই। একটা সাবজেক্ট চালু করার জন্য যতগুলি আসন থাকে সেগুলি যদি পূরণ করার মতো ছাত্র থাকে তাহলে সাবজেক্ট চালু করায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনীহা থাকার কথা নয়। আমার মনে হয় অযথা বিতর্ক সৃষ্টি করার জন্যই এই প্রশ্নটিই সামনে আনা হচ্ছে।
অসম সাহিত্য সভার সভাপতি বসন্তকুমার গোস্বামী একজন উদার মনের মানুষ। তার ইচ্ছা দীর্ঘদিন যাবত বরাত ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মধ্যে যে মানসিক বিভেদের সৃষ্টি হয়েছে এর স্থায়ী অবসান ঘটানো। দুই উপত্যকার মানুষের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক গভীর হলে তা রাজ্যের উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়ে উঠবে। সেজন্য তিনি বাংলা সাহিত্য সভা অসমের সঙ্গে নিয়ে বরাক সফরে আসেন। এ অঞ্চলের বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন, নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন, আন্তর্জাতিক বাংলা ভাষা মঞ্চ, বিশ্ব বঙ্গ সম্মেলন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ, সামাজিক সংস্থার রূপম সহ অনেক অগ্রগণ্য সংগঠন রয়েছে যারা এ উপত্যকার অধিকাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। যাদের সঙ্গে মতবিনিময় এর মাধ্যমে সমন্বয়ের সেতু বন্ধন করে তোলা সম্ভব হবে। কারও মনে আঘাত লাগে এমন কোন বক্তব্য উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে সমন্বয়ের ক্ষেত্রটি প্রসারিত হবে না বরং পথটি কণ্টকাকীর্ণ হয়ে থাকবে। বরাকের সিংহভাগ মানুষ চান নিজেদের আত্মভিমান ও মর্যাদা বজায় রেখে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক অন্যান্য ভাষিক গোষ্ঠীর সঙ্গে গড়ে তুলতে। সরকারি ওয়েবসাইটে যদি এখানকার ভাষা আন্দোলন বা বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন সম্পর্কে কোন ভুল তথ্য উপস্থাপন করা হয়ে থাকে তাহলে তাও সংশোধন করা প্রয়োজন। কোনও অঞ্চলের মানুষের মর্যাদা ক্ষুন্ন করে সংহতি রূপরেখা তৈরি করা মোটেও যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না। অসম সাহিত্য সভার সমন্বয় রচনার যে উদ্যোগ তা যাতে সরকারি কূটচালে বিভ্রান্তির পথে এগিয়ে না যায় সেদিকে সকলেরই নজর রাখা প্রয়োজন। রাজ্য সরকারের এ কথাটা মাথায় রাখা প্রয়োজন যে বরাক গোয়ালপাড়া নয়। আত্মমর্যাদায় আঘাত এলে এ উপত্যকার মানুষ গর্জে উঠতে জানেন। রাজনীতির কুশিলবরা অসাম সাহিত্য সভার সমন্বয়ের উদ্যোগকে কাঙ্খিত পথে যেতে দেবেন তো, এ প্রশ্নটা আমার মনে জেগেই রইলো।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)