সন্তানদের নিয়েই বাংলা চর্চা হোক

বরাক তরঙ্গ, ১৯ মে, সোমবার,
জ ১৯ শে মে। বরাক উপত্যকার সংগ্রামের ইতিহাসের একটি স্বর্ণ দিন। এই তারিখে মুখের ভাষা রক্ষা করতে ১১ জন বীর ভাষাসেনানী প্রাণ দিয়েছিলেন। তাঁদের আত্মবলিদানে আজ বরাক উপত্যকার তিনটি জেলার শিক্ষা মাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলার বর্ণমালা ব্যবহৃত হচ্ছে। অর্থাৎ রক্ষা হয়েছে মাতৃভাষা।

এই মহাসংগ্রামের দিনটি হল ১৯৬১ সালের ১৯ মে। এই আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক পরিতোষ পাল চৌধুরীর সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পৌঁছে সত্যাগ্রহ লড়াই। ১৯ মে শিলচর রেলস্টেশনে শুরু হয় সত্যাগ্রহ আন্দোলন। সেই আন্দোলনে কানাইলাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্রকুমার দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্রচন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকোমল পুরকায়স্থ ও কমলা ভট্টাচার্য পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। আর তাঁদের  আত্মবলিদানের যে ইতিহাস সেদিন রচিত হয়েছিল তা আজও আমাদের প্রেরণা যোগায় অন্যায়, অত্যাচার, বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের।

অসম একটি বহুভাষিক রাজ্য হওয়া সত্ত্বেও অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা করার লক্ষ্যে ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা বিধানসভায় বিল উত্থাপন করেন। সে বছরই ২৪ অক্টোবর অসম বিধানসভায় বিলটি আইনে পরিণত হয়। জোর করে অসমিয়া ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ১৯৬১ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ নামে একটি সংগঠনের জন্ম হয়েছিল। সরকারের এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ১৪ এপ্রিল অবিভক্ত কাছাড় জেলার শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি মহকুমায় ‘সংকল্প দিবস’ পালিত হয়। কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ ২৪ এপ্রিল থেকে ২ মে পর্যন্ত একটি দীর্ঘ পদযাত্রার আয়োজন করে বরাক উপত্যকার প্রায় প্রতিটি গ্রামে জোরালো প্রচার চালায়। পদযাত্রার শেষে পরিষদের পক্ষ থেকে ১৩ মে’র মধ্যে ভাষা আইনে পরিবর্তন এনে বাংলা ভাষাকেও বরাক উপত্যকার জনগণের জন্য অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের জোরালো দাবি উত্থাপন করা হয়। অন্যথায় ১৯ মে থেকে লাগাতার হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১৯ মে বরাক উপত্যকার তিন মহকুমা যথাক্রমে শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দির সর্বত্র হরতাল শুরু হয়। সেদিন শিলচর রেল স্টেশনে আন্দোলনকারীদের উপর দুপুর আড়াইটা নাগাদ পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে নয়জনকে হত্যা করে এবং আরও তিন জন গুরুতর ভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরবর্তীতে আরও দু’জনের মৃত্যু হয়। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বরাক উপত্যকার আবাল বৃদ্ধ বণিতা তীব্র প্রতিবাদে সোচ্চার হন। ২০ মে সান্ধ্য আইনকে উপেক্ষা করে হাজার হাজার জনতা শহিদদের মরদেহ নিয়ে মিছিলে সামিল হন। আন্দোলনের তীব্রতায় অসম সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং ভাষা আইনে পরিবর্তন এনে বাংলা ভাষাকে বরাক উপত্যকার সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।

সন্তানদের নিয়েই বাংলা চর্চা হোক

যদিও উগ্র-প্রাদেশিকতাবাদীদের চক্রান্ত থেমে থাকেনি। ১৯৭২ ও ১৯৮৬ সালেও পুনরায় অসমিয়া ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করা হয়। কিন্তু ভাষাপ্রেমীদের তীব্র আন্দোলন ও আত্মবলিদানে মাতৃভাষার মর্যাদা সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু বর্তমানে পরিকল্পিতভাবে পাঠ্যপুস্তকে, সরকারি বিজ্ঞাপনে, প্র-পত্র ইত্যাদিতে অসমিয়া ভাষার প্রয়োগ করা হচ্ছে। সেই আগ্রাসন আজও রয়েছে। এর ষড়যন্ত্র ও আগ্রাসন রোধ করতে হলে ভাষা শহিদদের আত্মবলিদানের অনুপ্রেরণা নিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে পাশাপাশি বাংলার চর্চা বেশি করে চালিয়ে যেতে হবে বরাকের বাঙালিদের। এবং নিজের সন্তানদেরও এই চর্চায় স্থান দিতে হবে। প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করাতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই। তবে বিশ্বকে জানতে হলে ইংরেজি জানা আবশ্যক। কিন্তু মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে চলবে না। চিন্তাশক্তি জন্মায় মাতৃভাষায়। আর মাতৃভাষাকে শক্তিশালী করতে হলে চর্চার প্রয়োজন। এই চর্চা সন্তানদের মধ্যে যদি না হয় তাহলে সেই আন্দোলন একদিন তাঁদের কাছে অজানা হয়ে যাবে।

Author

Spread the News